ইউভাল হারারি - মনুষ্যজতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস 1-0

1:59 am Unknown 0 Comments

মনুষ্যজতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের(1,0)



ষাট কেজি ওজনের একটা টিপিক্যাল স্তন্যপায়ীর মস্তিষ্কের আয়তন হয় বড়জোর ২০০ সিসি। অথচ আড়াই মিলিয়ন বছর আগেই মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল ৬০০ সিসি'র মত। কালের বিবর্তনে সেটা আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৩শ' কি ১৪শ' সিসি।
এই বিরাট আয়তনের মস্তিষ্ক কিন্তু খুব কাজের কিছু না। বিশেষ করে যেখানে শরীরের সমস্ত ক্যালরির ২৫ পার্সেন্ট সে একাই খরচ করে। এর ফলে মানুষকে দু'ভাবে মূল্য দিতে হয়েছে। এক, মস্তিষ্কের এই খাই খাই মেটানোর জন্য তাকে বেশি বেশি খাদ্যের সন্ধানে বেরোতে হয়েছে। আর মস্তিষ্ককে বেশি খাওয়াতে গিয়ে হাত-পায়ের মাংসপেশীর ভাগে খাবার পড়েছে কম।
ফলে, দিনে দিনে মানুষের মস্তিষ্ক প্রখর হয়েছে বটে। কিন্তু হাত-পা হয়ে গেছে দুর্বল। আমাদের বাপ-দাদাদের তুলনায় আমরা যে শারীরিকভাবে দুর্বল---এতে আর আশ্চর্য কী!
আজকাল না হয় আমরা বড় মস্তিষ্কের সুবিধা ভোগ করছি। মস্তিষ্ক খাটিয়ে বন্দুক আবিষ্কার করেছি। সেই বন্দুক দিয়ে জিম করবেটরা বাঘ-ভাল্লুক মারছেন। কিন্তু ইতিহাসের দীর্ঘ সময় জুড়ে তো আমাদের কাছে তীর-ধনুকের চেয়ে বেশি কিছু অস্ত্রপাতি ছিল না। মস্তিষ্কের খুব কমই আমরা ব্যবহার করেছি সেই সময়টায়। এই বিরাট মস্তিষ্ক তাই এক রকম বোঝাই ছিল আমাদের জন্য। তারপরও ক্রমাগত দুই মিলিয়ন বছর জুড়ে মস্তিষ্কের সাইজ কেন বেড়ে চললো? ফ্র্যাঙ্কলি, এর উত্তর আমারা জানি না।
স্তন্যপায়ীদের সাথে আমাদের আরেকটা পার্থক্য তৈরি হয় আমরা যখন শিরদাঁড়া সোজা করে দু'পায়ে দাঁড়াতে শিখি। এই দাঁড়ানোর ফলে আমরা কিছু এ্যাডেড বেনিফিট প্পাই। দাঁড়াতে শেখায় আমরা দূর থেকেই শত্রুকে সনাক্ত করতে শিখি। সেই সাথে হাত দিয়ে পাথর ছুঁড়ে শত্রুকে ঘায়েল করতে শিখি।
এটা একটা পজিটিভ ফিডব্যাক লুপের মত। হাত দিয়ে কাজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় হাতের শিরায় শিরায় নার্ভের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর নার্ভের পরিমাণ বাড়তে থাকায় হাত দিয়ে আমরা আরো আরো কমপ্লেক্স কাজ করতে শিখি। পাথর ছোঁড়া ফেজ পেরিয়ে আমরা তীর-ধনুকের মত সফিস্টিকেটেড হাতিয়ার ডিজাইন করা শিখি।
কিন্তু সবকিছুরই একটা উলটো দিক আছে। দাঁড়াতে শেখার ফলে মানুষের পিঠে ভালো প্রেশার পড়ে। দেখা দেয় মেরুদন্ড ও ঘাড়ের ব্যথার মত অভূতপূর্ব সমস্যা । বলা বাহুল্য, এতো ভারী একটা মাথাকে বহন করা কিন্তু সহজ কাজ নয়। মানুষের মাথার ওজন সমস্ত শরীরের ওজনের ২-৩%। শুনে কম মনে হচ্ছে তো? কিন্তু আমাদের ভাই-বেরাদরদের সাথে তুলনা করলে বুঝবেন, এটা কতো বেশি! যেখানে গরিলার ক্ষেত্রে এর মান মাত্র ০.২% আর শিম্পাঞ্জীর ক্ষেত্রে ০.৮%।
একে তো মাথার ভার বেশি। সেই ভার বহন করা মুশকিল, তার উপর সেটা যদি দাঁড়ায়ে বহন করতে হয়। আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি দেখে ব্যাপারটা গায়ে লাগে না। কিন্তু একটু চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন। এতো ভারী একটা জিনিস আপনি অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে বহন করছেন। নিজের সামর্থ্যের প্রতি একটা অন্যরকম শ্রদ্ধা চলে আসবে 
দাঁড়াতে শেখায় সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে নারীদের। এর ফলে নারীদের শ্রোণীদেশ দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছিল। সেটা সমস্যা না। সমস্যা হল, এর ফলে বাচ্চা জন্মাবার রাস্তাও দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে বাচ্চাদের মাথার সাইজ জেনারেশন থেকে জেনারেশনে বড় হচ্ছে। মাথার সাইজ বাড়ছে, কিন্তু সেই মাথা বের হবার রাস্তা দিনকে দিন ছোট হচ্ছে। প্রসবকালীণ শিশু ম্‌ত্যুর ব্যাপকতা তাই মানব জাতির জন্য একটা বিরাট কনসার্ন হয়ে দেখা দিল।
দেখা গেলো, যেসব মা বাচ্চা জন্ম নেবার নরমাল সময়ের আগেই বাচ্চা ডেলিভারী দিচ্ছেন, তাদের বাচ্চা বেঁচেবর্তে উঠছে। দেরি করলেই মা-শিশু দু'জনই মারা খাচ্ছে। কাজেই, ন্যাচারাল সিলেকশন বলে---তাড়াতাড়ি বাচ্চা মায়ের পেট থেকে বের হওয়াই ভালো।
তাড়াতাড়ি বাচ্চা বের হতে গিয়ে আরেক সমস্যা দেখা দিল। এই শিশুদের শরীরের বেশ কিছুত গুরুত্বপূর্ণ অংশই তখনো আন্ডার-ডেভেলপড। অন্য প্রাণীদের বাচ্চারা যেখানেই জন্মের পরপরই মোটামুটি হাঁটতে-দৌড়ুতে পারে, মানব শিশু সেখানে নেহাতই বোকাচ্চো।
এতে অবশ্য আমাদের একটা লাভ হয়েছে। মা যেহেতু একা শিশুটির খাবারের সংস্থান করতে পারছে না, সেই খাবার যোগাড়ের জন্য একজন বাবা'র প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। বায়োলজিক্যাল বাবা না, সামাজিক বাবা। যে মা ও শিশুটার জন্য বনেবাদাড়ে যুদ্ধ করে খাবার নিয়ে আসবে। আবার শিশু জন্মের পর পর মা-বাবা দু'জনের পক্ষেও অনেক সময় সেই দুর্বল শিশুটার সব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তাদের আশেপাশের মানুষের সাহায্য প্রয়োজন। এই সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে তাদের বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন। এইভাবে একটা শিশুকে মানুষ করার জন্য যে সোশ্যাল নটটা গড়ে উঠছে---তাই পরবর্তীতে গোত্র বা গোষ্ঠী গঠনে সাহায্য করবে। আর মানুষকে এগিয়ে দেবে বহুদূর।
(ইউভাল হারারি---এক কিস্তি শূন্য)

You Might Also Like

0 comments: