Binary Ascii Characters Table

3:44 pm Unknown 0 Comments

CharAsciiBinary
!chr(33)00100001
"chr(34)00100010
#chr(35)00100011
$chr(36)00100100
%chr(37)00100101
&chr(38)00100110
'chr(39)00100111
(chr(40)00101000
)chr(41)00101001
*chr(42)00101010
+chr(43)00101011
,chr(44)00101100
-chr(45)00101101
.chr(46)00101110
/chr(47)00101111
0chr(48)00110000
1chr(49)00110001
2chr(50)00110010
3chr(51)00110011
4chr(52)00110100
5chr(53)00110101
6chr(54)00110110
7chr(55)00110111
8chr(56)00111000
9chr(57)00111001
:chr(58)00111010
;chr(59)00111011
<chr(60)00111100
=chr(61)00111101
>chr(62)00111110
?chr(63)00111111
@chr(64)01000000
Achr(65)01000001
Bchr(66)01000010
Cchr(67)01000011
Dchr(68)01000100
Echr(69)01000101
Fchr(70)01000110
Gchr(71)01000111
Hchr(72)01001000
Ichr(73)01001001
Jchr(74)01001010
Kchr(75)01001011
Lchr(76)01001100
Mchr(77)01001101
Nchr(78)01001110
Ochr(79)01001111
Pchr(80)01010000
Qchr(81)01010001
Rchr(82)01010010
Schr(83)01010011
Tchr(84)01010100
Uchr(85)01010101
Vchr(86)01010110
Wchr(87)01010111
Xchr(88)01011000
Ychr(89)01011001
Zchr(90)01011010
[chr(91)01011011
\chr(92)01011100
]chr(93)01011101
^chr(94)01011110
_chr(95)01011111
`chr(96)01100000
achr(97)01100001
bchr(98)01100010
cchr(99)01100011
dchr(100)01100100
echr(101)01100101
fchr(102)01100110
gchr(103)01100111
hchr(104)01101000
ichr(105)01101001
jchr(106)01101010
kchr(107)01101011
lchr(108)01101100
mchr(109)01101101
nchr(110)01101110
ochr(111)01101111
pchr(112)01110000
qchr(113)01110001
rchr(114)01110010
schr(115)01110011
tchr(116)01110100
uchr(117)01110101
vchr(118)01110110
wchr(119)01110111
xchr(120)01111000
ychr(121)01111001
zchr(122)01111010
{chr(123)01111011
|chr(124)01111100
}chr(125)01111101
~chr(126)01111110
n/achr(127)01111111
€chr(128)10000000
‚chr(130)10000010
Æ’chr(131)10000011
„chr(132)10000100
…chr(133)10000101
†chr(134)10000110
‡chr(135)10000111
ˆchr(136)10001000
‰chr(137)10001001
Å chr(138)10001010
‹chr(139)10001011
Å’chr(140)10001100
Žchr(142)10001110
‘chr(145)10010001
CharAsciiBinary
’chr(146)10010010
“chr(147)10010011
”chr(148)10010100
•chr(149)10010101
–chr(150)10010110
—chr(151)10010111
Ëœchr(152)10011000
â„¢chr(153)10011001
Å¡chr(154)10011010
›chr(155)10011011
Å“chr(156)10011100
žchr(158)10011110
Ÿchr(159)10011111
chr(160)10100000
¡chr(161)10100001
¢chr(162)10100010
£chr(163)10100011
¤chr(164)10100100
Â¥chr(165)10100101
¦chr(166)10100110
§chr(167)10100111
¨chr(168)10101000
©chr(169)10101001
ªchr(170)10101010
«chr(171)10101011
¬chr(172)10101100
chr(173)10101101
®chr(174)10101110
¯chr(175)10101111
°chr(176)10110000
±chr(177)10110001
²chr(178)10110010
³chr(179)10110011
´chr(180)10110100
µchr(181)10110101
¶chr(182)10110110
·chr(183)10110111
¸chr(184)10111000
¹chr(185)10111001
ºchr(186)10111010
»chr(187)10111011
¼chr(188)10111100
½chr(189)10111101
¾chr(190)10111110
¿chr(191)10111111
Àchr(192)11000000
Áchr(193)11000001
Âchr(194)11000010
Ãchr(195)11000011
Ächr(196)11000100
Ã…chr(197)11000101
Æchr(198)11000110
Çchr(199)11000111
Èchr(200)11001000
Échr(201)11001001
Êchr(202)11001010
Ëchr(203)11001011
ÃŒchr(204)11001100
Íchr(205)11001101
ÃŽchr(206)11001110
Ïchr(207)11001111
Ðchr(208)11010000
Ñchr(209)11010001
Ã’chr(210)11010010
Óchr(211)11010011
Ôchr(212)11010100
Õchr(213)11010101
Öchr(214)11010110
×chr(215)11010111
Øchr(216)11011000
Ùchr(217)11011001
Úchr(218)11011010
Ûchr(219)11011011
Ãœchr(220)11011100
Ýchr(221)11011101
Þchr(222)11011110
ßchr(223)11011111
àchr(224)11100000
áchr(225)11100001
âchr(226)11100010
ãchr(227)11100011
ächr(228)11100100
Ã¥chr(229)11100101
æchr(230)11100110
çchr(231)11100111
èchr(232)11101000
échr(233)11101001
êchr(234)11101010
ëchr(235)11101011
ìchr(236)11101100
íchr(237)11101101
îchr(238)11101110
ïchr(239)11101111
ðchr(240)11110000
ñchr(241)11110001
òchr(242)11110010
óchr(243)11110011
ôchr(244)11110100
õchr(245)11110101
öchr(246)11110110
÷chr(247)11110111
øchr(248)11111000
ùchr(249)11111001
úchr(250)11111010
ûchr(251)11111011
üchr(252)11111100
ýchr(253)11111101
þchr(254)11111110
ÿchr(255)11111111

0 comments:

পৃথিবীর সর্বপ্রথম ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রাম

1:50 pm Unknown 0 Comments

জ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগেকার কথা। সময়টা ছিলো ১৯৪২ সাল। আমেরিকার সরকার টপ সিক্রেট একটি প্রজেক্ট হাতে নিলো- আমেরিকার সর্বপ্রথম ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রাম করতে হবে। এজন্য ডাক পড়লো ৬জন গণিতবিদের। রাত-দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে তারা এমন একটি কম্পিউটার তৈরিতে সক্ষম হন যা তখনকার দিনের অন্য যেকোনো মেশিনের তুলনায় ১০,০০০ গুণ দ্রুততার সাথে কাজ করতে পারতো। এত বিশাল অবদান সত্ত্বেও মানবজাতি অনেকদিন ধরেই তাদের এ অবদানটির কথা জানতে পারে নি। কারণ? কারণ তারা ছিলেন নারী! ৬ জনের এ দলের সদস্যরা হলেন- বেটি জিন জেনিংস বার্টিক, ক্যাথলিন ম্যাকনাল্টি মোশলে আন্তোনেলী, রুথ লিচারম্যান টীটেলবাম, ফ্রান্সিস বিলাস স্পেন্স, মার্লিন ওয়েস্কফ মেল্টযার এবং বেটি স্নাইডার হোলবার্টন। তারা যে মেশিনটির প্রোগ্রামিংয়ে হাত দিয়েছিলেন তার নাম এনিয়াক (ENIAC – Electronic Numerical Integrator And Computer)। যদিও এনিয়াক বানানোর কাজটি অধিকাংশই পুরুষদের করা, কিন্তু এর প্রোগ্রামিংয়ের কৃতিত্ব পুরোটাই ৬জনের এ দলটির প্রাপ্য। মজার ব্যাপার হলো, তাদের এ দলটিকে তখন চমৎকার এক নামে ডাকা হতো- ‘কম্পিউটার্স (Computers)’। দলের প্রত্যেক সদস্যই ছিলেন টপ ম্যাথম্যাটিকস গ্র্যাজুয়েট। তাদের দায়িত্ব ছিলো কম্পিউটারকে চিন্তা করতে শেখানো। রাত-দিন ধরে অসংখ্য ওয়্যারিং ডায়াগ্রাম নিয়ে পড়ে থাকতে হতো তাদের। শেষ পর্যন্ত তারা যখন সফল হলেন তখন এনিয়াকে ছিলো ১৭,৪৬৮টি ভ্যাকুয়াম টিউব, ৭,২০০টি ক্রিস্টাল ডায়োড, ১,৫০০টি রিলে, ৭০,০০০ রেজিস্টর, ১০,০০০ ক্যাপাসিটর এবং প্রায় ৫,০০০,০০০ হাতে ঝালাই করা জয়েন্ট!
এত বিশাল এক কাজ সারার পর তাদের প্রাপ্তি? রিপোর্টাররা যখন এনিয়াককে নিয়ে রিপোর্ট করতে আসলো, তখন তাদেরকে তারা ভেবেছিলো স্রেফ মডেল! সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের প্রশংসাপত্র দেয়া হয়। কিন্তু ওটুকুই, প্রজেক্টিতে অফিসিয়ালি তাদের কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয় নি। যে রাতে এনিয়াককে উদ্বোধন করা হয়, সেই রাতের ডিনার পার্টিতে তাদের পুরুষ সহকর্মীরা আমন্ত্রণ পেলেও তাদের ভাগ্যে সেটিও জোটেনি! এভাবেই কেটে যায় প্রায় পঞ্চাশটি বছর। অবশেষে এনিয়াকের সাথে সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। ১৯৯৭ সালে উইমেন ইন টেকনোলজি হল অফ ফেমে জায়গা করে নেন এ ৬ নারী। একই বছর হোলবার্টন জিতে নেন অগাস্টা আডা লাভলেস অ্যাওয়ার্ড- কম্পিউটারে নারীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ প্রদত্ত অন্যতম সম্মানজনক এক পুরষ্কার। ১৫ই ফেব্রুয়ারিকে ‘এনিয়াক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে শুধুমাত্র তাদেরই সম্মানার্থে। তাদের নিয়ে ২০১৪ সালে একটি ডকুমেন্টরি বানানো হয়েছিলো, নাম ‘দ্য কম্পিউটার্স’। ২০১৫ সালে সফটওয়্যার ইঞ্জিয়ারদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় যার নাম ছিলো ‘হোলবার্টন স্কুল’।
আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগেকার কথা। সময়টা ছিলো ১৯৪২ সাল। আমেরিকার সরকার টপ সিক্রেট একটি প্রজেক্ট হাতে নিলো- আমেরিকার সর্বপ্রথম ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রাম করতে হবে। এজন্য ডাক পড়লো ৬জন গণিতবিদের। রাত-দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে তারা এমন একটি কম্পিউটার তৈরিতে সক্ষম হন যা তখনকার দিনের অন্য যেকোনো মেশিনের তুলনায় ১০,০০০ গুণ দ্রুততার সাথে কাজ করতে পারতো। এত বিশাল অবদান সত্ত্বেও মানবজাতি অনেকদিন ধরেই তাদের এ অবদানটির কথা জানতে পারে নি। কারণ? কারণ তারা ছিলেন নারী! ৬ জনের এ দলের সদস্যরা হলেন- বেটি জিন জেনিংস বার্টিক, ক্যাথলিন ম্যাকনাল্টি মোশলে আন্তোনেলী, রুথ লিচারম্যান টীটেলবাম, ফ্রান্সিস বিলাস স্পেন্স, মার্লিন ওয়েস্কফ মেল্টযার এবং বেটি স্নাইডার হোলবার্টন। তারা যে মেশিনটির প্রোগ্রামিংয়ে হাত দিয়েছিলেন তার নাম এনিয়াক (ENIAC – Electronic Numerical Integrator And Computer)। যদিও এনিয়াক বানানোর কাজটি অধিকাংশই পুরুষদের করা, কিন্তু এর প্রোগ্রামিংয়ের কৃতিত্ব পুরোটাই ৬জনের এ দলটির প্রাপ্য। মজার ব্যাপার হলো, তাদের এ দলটিকে তখন চমৎকার এক নামে ডাকা হতো- ‘কম্পিউটার্স (Computers)’। দলের প্রত্যেক সদস্যই ছিলেন টপ ম্যাথম্যাটিকস গ্র্যাজুয়েট। তাদের দায়িত্ব ছিলো কম্পিউটারকে চিন্তা করতে শেখানো। রাত-দিন ধরে অসংখ্য ওয়্যারিং ডায়াগ্রাম নিয়ে পড়ে থাকতে হতো তাদের। শেষ পর্যন্ত তারা যখন সফল হলেন তখন এনিয়াকে ছিলো ১৭,৪৬৮টি ভ্যাকুয়াম টিউব, ৭,২০০টি ক্রিস্টাল ডায়োড, ১,৫০০টি রিলে, ৭০,০০০ রেজিস্টর, ১০,০০০ ক্যাপাসিটর এবং প্রায় ৫,০০০,০০০ হাতে ঝালাই করা জয়েন্ট!
এত বিশাল এক কাজ সারার পর তাদের প্রাপ্তি? রিপোর্টাররা যখন এনিয়াককে নিয়ে রিপোর্ট করতে আসলো, তখন তাদেরকে তারা ভেবেছিলো স্রেফ মডেল! সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের প্রশংসাপত্র দেয়া হয়। কিন্তু ওটুকুই, প্রজেক্টিতে অফিসিয়ালি তাদের কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয় নি। যে রাতে এনিয়াককে উদ্বোধন করা হয়, সেই রাতের ডিনার পার্টিতে তাদের পুরুষ সহকর্মীরা আমন্ত্রণ পেলেও তাদের ভাগ্যে সেটিও জোটেনি! এভাবেই কেটে যায় প্রায় পঞ্চাশটি বছর। অবশেষে এনিয়াকের সাথে সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। ১৯৯৭ সালে উইমেন ইন টেকনোলজি হল অফ ফেমে জায়গা করে নেন এ ৬ নারী। একই বছর হোলবার্টন জিতে নেন অগাস্টা আডা লাভলেস অ্যাওয়ার্ড- কম্পিউটারে নারীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ প্রদত্ত অন্যতম সম্মানজনক এক পুরষ্কার। ১৫ই ফেব্রুয়ারিকে ‘এনিয়াক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে শুধুমাত্র তাদেরই সম্মানার্থে। তাদের নিয়ে ২০১৪ সালে একটি ডকুমেন্টরি বানানো হয়েছিলো, নাম ‘দ্য কম্পিউটার্স’। ২০১৫ সালে সফটওয়্যার ইঞ্জিয়ারদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় যার নাম ছিলো ‘হোলবার্টন স্কুল’।

0 comments:

মনুষ্যজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস- অধ্যায়ঃ ১ (১/২)

2:27 am Unknown 0 Comments


ইউভাল নোয়া হারারি ইতিহাস পড়ান হিব্রু ইউভার্সিটি অব জেরুজালেমে। তাঁর রচিত বেস্টসেলার বই ‘Sapiens: A Brief History of Humankind‘ সম্প্রতি বেশ আলোড়ন তুলেছে। এরই মধ্যে এই বইটি প্রায় ৩০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইটিতে লেখক মানব জাতির বিবর্তন থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের নানা বিষয়কে দারুণভাবে বর্ণনা করেছেন। সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হলো, বিভিন্ন বিশ্লেষণে তিনি ব্যবহার করেছেন বিবর্তনীয় জীববিদ্যার নানা সিদ্ধান্ত। বইটির বাংলা অনুবাদ শুরু করেছি। অনুবাদ নিয়ে সকলের মতামত কামনা করছি। এই অধ্যায়টি পূর্বে সচলায়তন ব্লগে দু’টি  পর্বে প্রকাশিত হয়েছে। 
– সাজেদুল ওয়াহিদ নিটোল




ইউভাল নোয়া হারারি রচিত ‘সেপিয়েন্স: এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ হিউম্যানকাইন্ড

অধ্যায়: ১
একটি গুরুত্বহীন প্রাণী




আজ থেকে প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে, বিগ ব্যাং নামক এক মহাজাগতিক ঘটনার ফলে বস্তু, শক্তি, সময় এবং স্থানের উদ্ভব ঘটেছিল। আমাদের মহাবিশ্বের এসব মৌলিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করে জ্ঞানের যে শাখা- তার নাম পদার্থবিদ্যা।
বিগ ব্যাং এর প্রায় তিন লক্ষ বছর পর, বস্তু ও শক্তির পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় পরমাণু নামক জটিল কাঠামো তৈরি হতে থাকে; কিছু পরমাণু পরবর্তীতে একত্রিত হয়ে অণুতে পরিণত হয়। এই পরমাণু, অণু এবং তাদের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার গল্প শোনায়- রসায়ন।
প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বে, পৃথিবী নামক গ্রহে, কিছু নির্দিষ্ট অণুর বিক্রিয়ায় কিছু বৃহৎ ও জটিল কাঠামো গঠিত হলো; জন্ম নিলো প্রাণ। প্রাণ ও জীবের গল্পটি হলো জীববিদ্যা।
৭০,০০০ বছর আগে, হোমো সেপিয়েন্স নামক একটি প্রজাতি বিস্তৃত সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলতে শুরু করে; যাকে বলা হয় সংস্কৃতি। মানুষের সংস্কৃতির ক্রমবিকাশই গড়ে তুলেছে ইতিহাস।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ইতিহাসের গতিপথকে আকার দিয়েছে: (১) বৌদ্ধিক বিপ্লব; ৭০ হাজার বছর আগে যার ফলে আধুনিক মানব-ইতিহাসের সূচনা হয়। (২) কৃষিজ বিপ্লব; যা শুরু হয়েছিল ১২,০০০ বছর পূর্বে; (৩) বৈজ্ঞানিক বিপ্লব; যা মাত্র ৫০০ বছর আগে ঘটেছে, যে বিপ্লব টেনে আনতে পারে ইতিহাসের সমাপ্তি কিংবা জন্ম দিতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর। আলোচ্য তিনটি বিপ্লব কিংবা আন্দোলন কীভাবে মনুষ্য প্রজাতি এবং তার সঙ্গী জীবজগতকে প্রভাবিত করেছে- এই গ্রন্থ সেই গল্পটিই বলছে।
ইতিহাসের সূচনালগ্নের বহু আগে থেকেই মানুষ পৃথিবীতে ছিল। সর্বপ্রথম মনুষ্য আকৃতির প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে। কিন্তু আদি মানবেরা অগণিত প্রজন্ম ধরে হাজারো প্রজাতির জীবের সাথে নিজেদের আবাস ভাগাভাগি করে নিলেও বাকিদের চাইতে খুব একটা স্বতন্ত্র ছিল না।
আপনি যদি আজ থেকে ২ মিলিয়ন বছর আগের পূর্ব আফ্রিকায় বেড়াতে যান, তাহলে কিছু পরিচিত মনুষ্য চরিত্রের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারেন, যাদের মধ্যে থাকতে পারে: শিশুকে বুকে চেপে রাখা উদ্বিগ্ন মা; কাঁদায় খেলে বেড়ানো উচ্ছৃঙ্খল ছেলেপেলে; সমাজের কর্তৃত্বে বিরক্ত মেজাজি যুবক; ক্লান্ত বুড়ো যারা একটু শান্তিতে থাকতে চায়; কোনো সুন্দরীর আকর্ষাণার্থী বুক চাপড়ে বেড়ানো পেশিবহুল পুরুষ; এবং জীবনের সব দেখে ফেলা বৃদ্ধ কর্ত্রী। এইসব আদি-মানবেরা ভালোবাসতো, খেলত, তৈরি করতো বন্ধুত্ব; আবার ক্ষমতা ও মর্যাদার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো। কিন্তু শিম্পাঞ্জী, বেবুন এবং হাতিরাও তো তা-ই করতো। এসবের মাঝে অসাধারণ কিছুই ছিল না। সে যুগের পৃথিবীর কারো কাছে বিন্দুমাত্র ধারণাই ছিল না যে এই প্রাগৈতিহাসিক মানবদের উত্তরসূরিরা ভবিষ্যতে কোনো একদিন চাঁদে হেঁটে বেড়াবে, বিভাজিত করবে পরমাণু, উপলব্ধি করবে জিনের সংকেত এবং লিখবে ইতিহাসের বই। এমনকি আদি মানবেরাও হয়ত নিজেদের নিয়ে এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখত না। প্রাগৈতিহাসিক মানবদের সম্পর্কে যে বিষয়টি জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- এরা ছিল তাৎপর্যহীন ও গৌণ প্রাণী-গোষ্ঠী যারা তাদের প্রতিবেশে কোনো গরিলা, জোনাকিপোকা কিংবা জেলিফিশের চেয়ে খুব একটা বেশি প্রভাব রাখতে পারে নি।
জীববিজ্ঞানীরা জীবজগতকে বিভিন্ন প্রজাতিতে শ্রেণিবদ্ধ করেন। যেসব প্রাণী নিজেদের মধ্যে যৌনমিলনের মাধ্যমে উর্বর উত্তরসূরির জন্ম দিতে পারে তাদেরকে একই ‘প্রজাতি’র (species) অন্তর্ভূত প্রাণী হিশেবে গণ্য করা হয়। যেমন, ঘোড়া ও গাধার রয়েছে সাধারণ পূর্বসূরি এবং তাদের মধ্যে প্রচুর শারীরিক মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু তারা পরস্পরের সাথে যৌনমিলনে আগ্রহী নয়। তবে বাধ্য করা হলে তারা মিলিত হবে- কিন্তু জন্ম নেবে অনুর্বর সন্তান। যে কারণে গাধার ডিএনএতে ঘটা পরিব্যক্তি কখনো ঘোড়ার ডিএনএ’র সাথে মিশ্রিত হতে পারে না। এই দুই ধরনের প্রাণীকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি প্রজাতির সদস্য গণ্য করা হয় কারণ বিবর্তনের পথ ধরে বহুকাল আগেই এরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অন্যদিকে, একটি বুলডগ ও একটি স্প্যানিয়েল দেখতে যতোই ভিন্ন হোক না কেন তারা কিন্তু একই প্রজাতির প্রাণী; তারা অনুরূপ ডিএনএ সেটের অংশীদার। অত্যন্ত আনন্দের সাথে তারা পরস্পর মিলিত হবে এবং তাদের বাচ্চাকাচ্চা বড় হয়ে অন্য কুকুরের সাথে মিলিত হয়ে আরো সন্তান-সন্ততি উৎপাদন করবে।
যেসব প্রজাতি অতীতের একটি সাধারণ পূর্বসূরি থেকে উৎপত্তি লাভ করে কালক্রমে বিবর্তিত হয়েছে তাদেরকে ‘গণ’(Genus) নামক দলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাঘ, সিংহ, চিতা এবং জাগুয়ার প্রত্যেকে ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী হলেও প্রত্যেকে ‘প্যানথেরা’(Panthera) গণের অন্তর্ভুক্ত। জীববিজ্ঞানীরা প্রতিটি জীবকেই একটি দ্বিপদী ল্যাটিন নাম দিয়েছেন; যার প্রথমটি নির্দেশ করে গণ, পরেরটি প্রজাতি। উদাহরণস্বরূপ, সিংহের বৈজ্ঞানিক নাম হলো ‘প্যানথেরা লিও’(Panthera leo), যেখানে ‘Panthera’ ও ‘leo’ যথাক্রমে গণ ও প্রজাতিকে নির্দেশ করছে। স্বাভাবিকভাবেই, এই বইটি যারা পড়ছেন তাদের সবাই-ই ‘হোমো সেপিয়েন্স’(Homo sapiens) প্রজাতির প্রাণী। এখানে ‘Homo’(মানব) হলো গণের নাম এবং ‘sapiens’(জ্ঞানী) হলো প্রজাতি।
আবার বেশ কিছু গণের প্রাণী একত্রিত হয়ে গঠন করে ‘গোত্র’ (Family); যেমন- বিড়াল গোত্র (সিংহ, চিতা, সাধারণ বিড়াল), কুকুর গোত্র (নেকড়ে, শৃগাল, খেঁকশিয়াল), হাতি গোত্র (হাতি, ম্যামথ, মাস্তডন) ইত্যাদি। প্রতিটি গোত্রের সদস্যই অতীতের কোনো এক কালে একটি সাধারণ পূর্বসূরি থেকে উৎপত্তি লাভ করে বিবর্তিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের বাড়িতে বসবাস করা সাধারণ বিড়াল থেকে শুরু করে আফ্রিকার ভয়ংকর সিংহ, প্রত্যেকেরই একটি সাধারণ পূর্বসূরি রয়েছে যারা আজ থেকে ২৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে চরে বেড়াত।

 হোমো সেপিয়েন্সও একটি নির্দিষ্ট গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তবে এই সাধারণ তথ্যটি ছিল মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে গুপ্ত রহস্যগুলোর একটি। আমরা, মানুষেরা, সর্বযুগেই নিজেদেরকে প্রাণিজগৎ থেকে একেবারে আলাদা একটি জাতি হিশেবে বিবেচনা করেছি; যেন আমরা পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ, আমাদের নেই কোনো জ্ঞাতি ভাইবোন কিংবা দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ব্যাপারটি সত্য নয়। আপনি পছন্দ করুন বা না-ই করুন, আমরা সকলেই একটি বিশাল এবং বিশেষভাবে গোলমেলে গোত্রের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী; গোত্রের নাম ‘মহান বানর’ ( The Great apes)। আমাদের কাছের আত্মীয়ের মাঝে এখনও বেঁচে আছে শিম্পাঞ্জী, গরিলা এবং ওরাংওটাং। বেঁচে থাকা আত্মীয়দের মধ্যে শিম্পাঞ্জী আমাদের সবচাইতে নিকটবর্তী । মাত্র ৬ মিলিয়ন বছর আগে, কোনো এক নারী এপের (Ape) দু’টো কন্যাসন্তান জন্মেছিল; যাদের একজন পরিণত হয়েছিল সকল শিম্পাঞ্জীর পূর্বসূরিতে, অন্যজন হলো আমাদের সবার আদি মাতামহ।

লুকিয়ে থাকা ফসিল


হোমো সেপিয়েন্স দারুণ রোমাঞ্চকর আরেকটি তথ্য লুকিয়ে রেখেছিল। আমাদের যে বেশ কিছু দূরবর্তী আত্মীয় রয়েছে শুধু তা-ই নয়, বহুকাল আগে আমাদের অল্প কিছু ভাইবোনও ছিল। আমরা সাধারণত মনে করি যে, আমরাই পৃথিবীর একমাত্র মনুষ্য প্রজাতি, কারণ ১০ হাজার বছর ধরে কেবলমাত্র আমাদের প্রজাতিই পৃথিবীতে বিচরণ করেছে। যদিও ‘মানব’ শব্দের সত্যিকারের অর্থ হলো “Homo গণের অন্তর্গত প্রাণী”। তাই বলা যায়, হোমো সেপিয়েন্স ছাড়াও উক্ত গণের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীও একসময় পৃথিবীতে ছিল। উপরন্তু, এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে আমরা দেখব যে, অদূরবর্তী কোনো ভবিষ্যতে আমাদেরকে হয়ত ‘সেপিয়েন্স’ ভিন্ন কোনো মানব প্রজাতির সাথে যুঝতে হবে। একটি বিষয়ে স্পষ্ট করে বলি- এখন থেকে আমি হোমো সেপিয়েন্সকে নির্দেশ করতে প্রায়ই শুধুমাত্র ‘‘সেপিয়েন্স’’ শব্দটি ব্যবহার করব; আর ‘মানব’ বা ‘মানুষ’ দিয়ে নির্দেশ করব ‘Homo’ গণের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য মানব প্রজাতিকে।
প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর আগে, পূর্ব আফ্রিকায় বসবাসকারী ‘অস্ট্রালোপিথেকাস’ নামক লেজবিহীন বানরের গণ থেকে বিবর্তিত হয়ে আদি মানবেরা সর্বপ্রথম পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে, এই প্রাগৈতিহাসিক মানবদের একটি দল তাদের জন্মভূমি ছেড়ে নানান দিকে যাত্রা শুরু করে এবং ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ আর এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। যেহেতু উত্তর ইউরোপের তুষারাচ্ছন্ন এলাকায় বেঁচে থাকার জন্য যে ধরনের বৈশিষ্ট্যাবলী জরুরী সেগুলো ইন্দোনেশিয়ার প্লাবিত বনভূমিতে প্রয়োজনীয় গুণাবলীর তুলনায় ভিন্ন, সেহেতু বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত মানবগোষ্ঠীর বিবর্তন নানা বিচিত্র দিকে মোড় নেয়। যার ফলে পৃথক পৃথক কিছু মানব প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। বিজ্ঞানীরা এদের প্রত্যেকের জন্যই আলাদা বৈজ্ঞানিক নাম বরাদ্দ করেছেন।


 আদি মানবদের যে দল ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের নানা অঞ্চলে স্থায়ী হয়েছিল তারা কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে ‘Homo neanderthalensis’ ( ‘নিয়ান্ডার উপত্যকার মানব’) প্রজাতিতে পরিণত হয়। এদেরকে সাধারণভাবে শুধুমাত্র ‘নিয়ান্ডারথাল’ (Neanderthal) নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ইউরেশিয়ার নিয়ান্ডারথালরা বরফযুগের শীতল জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে অভিযোজিত হতে পেরেছিল। ওরা ছিল সেপিয়েন্সের তুলনায় বিশাল এবং অধিক পেশিবহুল। অন্যদিকে, এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে জনবসতি গড়ে তুলেছিল মানুষের আরেক প্রজাতি- ‘Homo erectus’, যার অর্থ ‘খাড়া মানব’। হোমো ইরেক্টাস হলো পৃথিবীতে সবচেয়ে দীর্ঘসময় বেঁচে থাকা মানব প্রজাতি; ওরা প্রায় ২০ লক্ষ বছর পৃথিবীতে বিচরণ করেছে। এই রেকর্ড খুব সম্ভবত অক্ষত থাকবে। কারণ আমাদের নিজ প্রজাতি ‘হোমো সেপিয়েন্স’ আগামী ১০০০ বছর বেঁচে থাকতে পারবে কিনা তা নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে; ২০ লক্ষ বছরের পথ পাড়ি দেয়া আমাদের সাধ্যের বাইরে।

ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে এক মানব প্রজাতি বাস করত যারা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে অভিযোজিত হতে পেরেছিল। ওদের নাম দেয়া হয়েছে ‘‘Homo soloensis’ (‘সোলো উপত্যকার মানব’)। ইন্দোনেশিয়ার আরেকটি ছোট দ্বীপ ফ্লোরেসে (Flores) আদি মানবদের একটি দলকে এমন একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় যার ফলে তারা হয়ে পড়ে খর্বাকৃতির। আদি মানবদের প্রথম দল যখন ফ্লোরেস দ্বিপে পৌঁছায় তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের স্তর অনেক নিচে ছিল। পরবর্তীতে যখন সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে যায় , তখন কিছু মানুষ সেই সম্বলহীন দ্বীপে আটকা পড়ে। বিশাল-দেহী মানুষ, যাদের বেঁচে থাকার জন্য বেশি খাদ্যের প্রয়োজন ছিল, তারা সবার আগে মারা পড়ে। তুলনামূলক ছোট মানুষেরা বেঁচে যায়। পরবর্তী প্রজন্মগুলোতেও একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এভাবে অনেকগুলো প্রজন্ম অতিবাহিত হবার পর ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ ‘‘খর্ব মানবে’’ পরিণত হয়। এই অনন্য প্রজাতির মানবদের, বিজ্ঞানীরা যাদের নাম দিয়েছেন ‘Homo floresiensis’ , উচ্চতা ছিল সর্বোচ্চ এক মিটার এবং ওজন কোনোভাবেই ২৫ কেজির বেশি নয়। খর্বাকৃতির মানব হওয়া স্বত্বেও এরা পাথরের নানা সরঞ্জাম তৈরি করতে পারত, এমনকি মাঝে মাঝে দ্বীপের হাতিও শিকার করতে পারত। যদিও সত্যি বলতে কি, ওই দ্বীপের হাতির প্রজাতিও ছিল খর্বাকৃতির।
২০১০ সালে, বিজ্ঞানীরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া আরেক সহোদরকে বিস্মৃতি থেকে উদ্ধার করেন যখন তাঁরা সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা দ্বীপের একটি গুহায় একটি প্রস্তরীভূত আঙ্গুলের হাড় খুঁজে পান। জিন-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয় যে, এই হাড় এযাবতকালের পরিচিত কোনো মানব প্রজাতির নয়। অজানা এই মানব প্রজাতির নাম দেয়া হয় ‘হোমো ডেনিসোভা’ (“Homo denisova”)। কে-ই বা জানে, আমাদের আরো কতো হারানো আত্মীয় আবিষ্কৃত হবার অপেক্ষায় আছে কোনো দ্বীপ, গুহা কিংবা ভূখণ্ডে!
যখন ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে বসবাসরত মানুষ বিবর্তিত হচ্ছিল, তখন কিন্তু পূর্ব আফ্রিকায় বিবর্তনের চাকা থেমে থাকে নি। মনুষ্যজাতির সূতিকাগার নতুন নতুন অনেক প্রজাতির জন্ম দিয়ে গেছে; যেমন- “Homo rudolfensis” (“লেক রুডলফের মানব”), “Homo ergaster” বা “কর্মঠ মানব”, এবং অবশেষে আমাদের নিজস্ব প্রজাতি, যাদেরকে আমরা খুব নির্লজ্জভাবে নাম দিয়েছি “Homo sapiens”, বা “জ্ঞানী মানব”।
এই প্রজাতিগুলোর সদস্যদের কেউ কেউ ছিল আকারে বিশাল এবং অন্যেরা খর্বাকৃতির। কেউবা ছিল হিংস্র শিকারি, আবার কেউ নেহাতই নিরীহ ফলমূল সংগ্রহকারী। কেউ বাস করত শুধুমাত্র একটি দ্বীপে, আবার কেউ কেউ পুরো মহাদেশজুড়ে। কিন্তু তাদের সকলেই ছিল ‘হোমো’ (Homo) গণের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি। ওরা সবাই ছিল মানুষ।
প্রজাতিগুলোর উৎপত্তির ক্রমকে সরলরৈখিক হিশেবে কল্পনা করাটা একটা সাধারণ হেত্বাভাস; যেমন- ইরগেস্টার জন্ম দিয়েছে ইরেক্টাসের, ইরেক্টাস থেকে জন্ম নিয়ে নিয়েছে নিয়ান্ডারথাল, এবং নিয়ান্ডারথাল থেকে বিবর্তিত হয়ে আমরা এসেছি। এই ধরনের সরলরৈখিক মডেল এমন একটি ভ্রান্ত চিত্রকল্প প্রদান করে যাতে মনে হয় যে ইতিহাসের কোনো নির্দিষ্ট একটি সময়ে শুধুমাত্র একটি মানব প্রজাতিই পৃথিবীতে বসবাস করত। সত্যটি হলো এই যে, প্রায় দুই মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে মোটামুটি ১০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত আমাদের এই পৃথিবীতে একই সময়ে একাধিক মানব প্রজাতির নিবাস ছিল। এবং কেন নয়? বর্তমানে শিয়াল, ভালুক কিংবা শুকরের একাধিক প্রজাতি আমরা দেখতে পাই; তাহলে মানুষের কেন নয়? এক লক্ষ বছর আগের পৃথিবীতে মানুষের অন্তত ছয়টি ভিন্ন প্রজাতি একই সময়ে পৃথিবীতে বিচরণ করেছে। তবে বহু-প্রজাতিসম্পন্ন অতীত নয়, আমাদের প্রজাতির একচ্ছত্র আধিপত্য-সম্পন্ন বর্তমানই বরং অদ্ভুত, এবং সম্ভবত দোষাবহও। শীঘ্রই আমরা দেখতে পাবো যে, আমাদের সহোদরদের স্মৃতি অন্তরীণ রাখার পেছনে সেপিয়েন্সের হাতে বেশ ভালো কিছু কারণ ছিল।

চিন্তাশক্তির মাশুল

নানা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, সব মানব প্রজাতিরই কিছু লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, অন্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষের মস্তিষ্ক অস্বাভাবিকভাবে বড়। যেসব স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওজন ৬০ কেজি তাদের মস্তিষ্কের গড়পড়তা আয়তন ২০০ ঘন সেন্টিমিটার। আড়াই মিলিয়ন বছর আগের সবচেয়ে প্রাচীন মানব নর-নারীর মস্তিষ্কের আকার ছিল প্রায় ৬০০ ঘন সেন্টিমিটারের কাছাকাছি। আধুনিক সেপিয়েন্সের মস্তিষ্কের গড় আয়তন ১২০০ থেকে ১৪০০ ঘন সেন্টিমিটার। নিয়ান্ডারথালদের মস্তিষ্ক ছিল আরো বড়।
আমাদের মনে হতে পারে যে, বিবর্তনের চাকা বড় মস্তিষ্ককে বেছে নিয়েছে- এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আমরা আমাদের উচ্চ বুদ্ধিমত্তা কর্তৃক এতোটাই মোহিত হয়ে থাকি যে, আমরা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিই- মস্তিষ্কের আকার যতো বড় এবং শক্তি যতো বেশি হবে ততো ভালো। কিন্তু এমনটাই যদি সত্যি হতো, তাহলে দেখা যেত বিবর্তনের পথে বিড়াল গোত্র থেকে এমন বিড়াল জন্ম নিচ্ছে যারা ক্যালকুলাস পারে। তাহলে পুরো প্রাণীজগতের মাঝে কেবল ‘হোমো’ গণের প্রজাতিগুলোর মাঝেই কেন এতো বিশাল ‘ভাবনা-যন্ত্র’ জন্ম নিয়েছে?
প্রকৃত ঘটনা হলো, দশাসই মস্তিষ্ক শরীরের জন্য একটি মস্ত ঝামেলা। একে-তো এটি বয়ে বেড়ানো সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে যখন একে একটি ঢাউস খুলির ভেতরে আবদ্ধ রাখতে হয়। তার ওপর এর জ্বালানী যোগানোও বেশ কঠিন কাজ। ‘হোমো সেপিয়েন্সের’ মস্তিষ্কের ওজন তার শরীরের মোট ওজনের শতকরা ২-৩ ভাগ মাত্র, কিন্তু শরীরের উৎপাদিত শক্তির অন্তত প্রায় শতকরা ২৫ ভাগই মস্তিষ্ক দখল করে নেয়, এমনকি বিশ্রামে থাকাকালীন সময়েও। অন্যদিকে, অন্যান্য এপের মস্তিষ্ক বিশ্রামকালে তাদের শরীরের উৎপাদিত শক্তির শতকরা ৮ ভাগ খরচ করে। প্রাগৈতিহাসিক মানবদেরকে এই বিশাল মস্তিষ্কের মাশুল দু’ভাবে গুণতে হয়েছিল। প্রথমত, তাদেরকে খাবারের খোঁজে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তাদের পেশিগুলো ক্রমে ক্ষয়ে গিয়েছিল। অনেকটা সরকার যেভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ শিক্ষাখাত থেকে সরিয়ে সামরিক খাতে নিয়ে আসে, তেমনই মানুষ তার শরীরের উৎপাদিত শক্তির গতি-মুখ বদলে মাংসপেশি থেকে নিউরনে নিয়ে আসে। এটি তখনকার তৃণভূমিতে বেঁচে থাকার জন্য খুব একটা ভালো কৌশল ছিল কিনা তা নিয়ে পূর্ব-সিদ্ধান্তে আসা খুব কঠিন। কেননা একটি শিম্পাঞ্জী কোনো হোমো সেপিয়েন্সের সাথে তর্কে জিততে পারবে না, কিন্তু চাইলে মানুষকে একটি পুতুলের মতো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারে।
আজকের দিনে আমাদের মস্তিষ্ক বেঁচে থাকতে দারুণ সাহায্য করছে, কারণ আমরা এই অঙ্গটির সাহায্য নিয়ে গাড়ি ও অস্ত্র তৈরি করতে পারি যা দিয়ে আমরা একটি শিম্পাঞ্জীর চাইতে জোরে ছুটতে পারি, এবং নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে গুলি করতে পারি, কোনোপ্রকার মল্লযুদ্ধে না গিয়েই। কিন্তু গাড়ি ও অস্ত্র- এসবই তো মাত্র সেদিনকার আবিষ্কার। প্রায় দুই মিলিয়ন বছর ধরে, মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের আকার শুধু বেড়েছে আর বেড়েছে, কিন্তু মনুষ্যজাতি এটা দিয়ে খুব বিশেষ কিছু করে দেখাতে পারে নি, কেবল মুষ্টিমেয় কিছু চকমকে ছুরি আর তীক্ষ্ণ বর্শা তৈরি করা ছাড়া। তাহলে দুই মিলিয়ন বছর ধরে মানুষের বিশাল মস্তিষ্কের এই বিবর্তনের হেতু কী? সত্যি বলতে কি, আমরা জানি না।

বিভিন্ন মনুষ্য-প্রজাতির মস্তিষ্কের আকারের তুলনামূলক চিত্র।
মানুষের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এই যে আমরা দু’পায়ে খাড়া হয়ে হাঁটতে পারি। খাড়া হয়ে দাঁড়ালে তৃণভূমিতে শিকার কিংবা শিকারির খোঁজ পাওয়াটা সহজতর হয়। আর সামনের বাহু দু’টো যেহেতু আর চলাচলের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না সেহেতু এগুলোকে অন্য কাজে লাগানো যায়, যেমন- পাথর ছোঁড়া কিংবা সংকেত প্রদান। হাতের ব্যবহারে যারা অধিকতর পটু ছিল, তারা অন্যদের তুলনায় ছিল বেশি সফল। তাই বিবর্তনীয় চাপ আমাদের হাতের আঙুল আর তালুতে স্নায়ুর সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং মাংসপেশিতে এনেছে সামঞ্জস্যতা। যার ফলে, মানুষ হাত দিয়ে জটিল সব কাজ সম্পাদন করতে পারে। বিশেষ করে, তারা বানাতে এবং ব্যবহার করতে পারে জটিল সব যন্ত্রপাতি। পাথুরে সরঞ্জাম ব্যবহারের একেবারে প্রাচীন যে প্রমাণ পাওয়া যায় তা প্রায় আড়াই মিলিয়ন বছর পুরনো। নৃতত্ত্ববিদেরা পাথুরে সরঞ্জামের ব্যবহার এবং উৎপাদনের চিহ্ন দেখেই প্রাচীন মানুষদের আলাদা করে চিনতে পারেন।
তবে খাড়া হয়ে হাঁটার কিছু অসুবিধাও আছে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমাদের পূর্বসূরি প্রাইমেটদের কঙ্কালতন্ত্র বিবর্তিত হয়েছে চার পায়ে হাঁটা প্রাণীদের জন্য, যাদের আছে অপেক্ষাকৃত ছোট মাথা। এই অবস্থায় খাড়া হয়ে দাঁড়ানোটা ছিল বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে যখন ঘাড়ে একটি অস্বাভাবিক আকৃতির খুলি বয়ে বেড়াতে হতো। মনুষ্যজাতিকে উন্নত দৃষ্টিশক্তি ও কর্মক্ষম হাত পাবার মূল্য চুকাতে হয়েছে পিঠ ব্যথা এবং অনমনীয় ঘাড়কে বরণ করে।
নারীরা মূল্য চুকিয়েছে সবচেয়ে বেশি। সোজা হয়ে চলাফেরার জন্য প্রয়োজন ছিল আরো সংকীর্ণ পশ্চাৎ-ভাগ, যার ফলে জননপথ ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে পড়ে। ব্যাপারটি ঘটেছে ঠিক সেই সময়েই যখন সদ্য জন্ম নেয়া শিশুদের মাথা বড় থেকে আরো বড় হচ্ছে। জন্মকালীন শিশুমৃত্যু নারীদের জন্য একটি বড় বিপত্তি হয়ে দাঁড়ায়। যেসব নারী তাড়াতাড়ি বাচ্চা জন্ম দিয়েছে, যখন শিশুর মস্তিষ্ক ও খুলি আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট ও নমনীয় থাকে, তাদের বেঁচে থাকা এবং আরো সন্তান জন্ম দেয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচন অপেক্ষাকৃত দ্রুত জন্মদানকে পক্ষপাত দেখিয়েছে। এবং সত্যি বলতে কী, অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষ অকালেই জন্ম নেয়, যখন শরীরের গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গ সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয় না। একটি অশ্বশাবক জন্মের কিছুক্ষণ পরেই হাঁটাচলা করতে পারে; একটি বিড়ালছানা মাত্র কয়েক সপ্তাহ বয়সেই মা’কে ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, মনুষ্য শিশুরা থাকে একেবারে অসহায়; তাদেরকে খাদ্য, নিরাপত্তা আর শিক্ষার জন্য বড়দের উপর নির্ভর করতে হয় বছরের পর বছর।
এই ব্যাপারটি একইসাথে মানুষের অসাধারণ সামাজিক দক্ষতা নির্মাণে এবং এর অনন্য সমস্যাগুলো তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। একা মায়েরা কখনোই নিজেদের এবং নিজেদের শিশুদের জন্য যথেষ্ট খাদ্য জোগাড় করতে পারতো না। শিশু বড় করে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল পরিবার ও প্রতিবেশীর সহায়তা। একটি শিশুকে মানুষ করে তোলার জন্য প্রয়োজন একটি পুরো গোত্র। স্বাভাবিকভাবেই, বিবর্তন তাদের প্রতি আনুকূল্য দেখিয়েছে যারা শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন গড়ে তুলতে পেরেছিল। উপরন্তু, মানুষ যেহেতু অপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে জন্ম নেয়, সেহেতু তাদেরকে অন্য যে কোনো প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে শিক্ষিত ও সামাজিক করে তোলা সম্ভব। বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী জন্ম নেয় অনেকটা মাটির পোড়ার পাত্রের মতো হয়ে, যাকে বাঁকাতে চাইলে আঁচড় পড়তে পারে কিংবা ভেঙেই যেতেই পারে। মানুষ জন্ম নেয় অনেকটা গলিত গ্লাসের মতো; তাদেরকে যেমন খুশি তেমন মোচড় দেয়া যায় কিংবা প্রসারিত করা যায় এবং ইচ্ছেমত আকার দেয়া যায়। এই কারণেই আজকে আমরা শিশুদেরকে খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ হিশেবে বড় করে তুলতে পারি, কিংবা গড়ে তুলতে পারি পুঁজিবাদী কিংবা সাম্যবাদী হিশেবে; এমনকি শান্তিপ্রিয় কিংবা রণ-লিপ্সু হিশেবে।
***
আমরা সাধারণত ধরে নিই যে, বড় মস্তিষ্ক, পাথুরে সরঞ্জামের ব্যবহার, যে কোনো কিছু শিখে নেয়ার উচ্চ ক্ষমতা এবং জটিল সামাজিক কাঠামোর মতো সুবিধাজনক গুণাবলী আমাদেরকে অন্য প্রাণীদের তুলনায় অনেক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এটা স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে হতে পারে যে, এই সকল সুবিধাবলীর কারণেই মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত গুণাবলীই মানুষের মানুষ উপভোগ করেছে প্রায় ২ মিলিয়ন বছর ধরে, তারপরও পুরো সময়েই মানুষ একটি দুর্বল ও প্রান্তীয় প্রজাতি হিশেবেই বেঁচে ছিল। মিলিয়ন বছর আগের আদি মানবেরা, বিরাট মস্তিষ্ক এবং তীক্ষ্ণ পাথুরে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও, প্রতিনিয়ত শিকারি প্রাণীর ভয়ে তটস্থ থাকত। তারা বড় প্রাণী খুব কমই শিকার করতে পারত; নিজেদের বাঁচিয়ে রাখত মূলত ফলমূল ও পোকামাকড় খেয়ে, মাঝেমধ্যে ছোট প্রাণী শিকার করে এবং অন্যান্য শিকারি প্রাণীর ফেলে যাওয়া শিকারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে।
সবচেয়ে প্রাচীন পাথুরে অস্ত্রগুলো সাধারণ যে কাজটিতে ব্যবহৃত হতো তা হলো- হাড় ভেঙ্গে সেখান থেকে অস্থিমজ্জা বের করে আনা। কিছু কিছু গবেষক মনে করে থাকেন যে, এটি মানুষের উদ্ভাবিত একটি মৌলিক কাজ। কাঠঠুকরে যেমন গাছের গুড়ি থেকে পোকা বের করে আনায় দক্ষ, ঠিক তেমনিভাবে আদি মানুষেরা হাড় থেকে অস্থিমজ্জা বের করে আনায় বিশিষ্টতা অর্জন করেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কেন অস্থিমজ্জা বের করে খেত ওরা? ওই সময়ের প্রেক্ষিতে নিজেকে কল্পনা করুন। আপনি দেখতে পেলেন, সিংহের দল একটি জিরাফ শিকার করেছে এবং পেট পুরে খাচ্ছে। আপনি ধৈর্যের সাথে ওদের খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইলেন। কিন্তু ওরা চলে গেলেও আপনার সুযোগ আসবে না, কেননা তখন হায়েনা আর শিয়ালের পালা, এবং আপনি বুদ্ধিমান হলে ওদের সাথে প্রতিযোগিতায় যাবার সাহস করবেন না। ওরা সিংহের ফেলে যাওয়া শিকারের বাকিটা চেটেপুটে খাবে। ওরা চলে যাবার পরই আপনার এবং আপনার গোত্রের পালা আসবে। আপনি খুব সতর্কভাবে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্টের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন কিছু অবশিষ্ট নেই, কেবল কিছু হাড় পড়ে আছে; তখন আপনি সেই হাড় ভেঙ্গে অস্থিমজ্জা বের করে খেতে শুরু করলেন।
এই ব্যাপারটি আমাদের ইতিহাস এবং মনোজগতকে বুঝে উঠার একটি চাবিকাঠি। কিছুকাল পূর্বেও, খাদ্য শৃঙ্খলে ‘হোমো’ গণের প্রাণীদের অবস্থান ছিল মাঝামাঝি। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে, মানুষ ছিল পৃথিবীর ছোট একটি প্রাণী- যারা যা যোগাড় করতে পারত তা-ই খেত; অন্যদিকে প্রায়শই অন্যান্য বড় শিকারি প্রাণীদের শিকারে পরিণত হতো। মাত্র ৪ লক্ষ বছর আগে, মানুষের অল্প কিছু প্রজাতি নিয়মিতভাবে বড় প্রাণী শিকার করতে শুরু করে, এবং মাত্র ১ লক্ষ বছর আগে- হোমো সেপিয়েন্সের উত্থানের পর- মনুষ্যজাতি লাফ দিয়ে খাদ্য শৃঙ্খলের চূড়ায় উঠে।
হঠাৎ করেই খাদ্য শৃঙ্খলের মাঝামাঝি অবস্থান থেকে চূড়ায় পৌঁছে যাওয়ার প্রভাবটি ছিল বেশ সাঙ্ঘাতিক। অন্যান্য যেসব প্রাণী খাদ্য শৃঙ্খলের একেবারে চূড়ায় ছিল, যেমন- সিংহ, হাঙর; তারা ওই অবস্থান অর্জন করেছে খুবই ধীরে ধীরে, কোটি বছরের বিবর্তনের পর। তাই পারিপার্শ্বিক বাস্তুতন্ত্র সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছে, যার ফলে সিংহ কিংবা হাঙর- কেউই খুব বেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে নি। সময়ের সাথে সিংহ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে ভয়ংকর শিকারি, একই সাথে হরিণের দল বিবর্তিত হয়ে আরো দ্রুত দৌড়াতে শিখেছে, হায়েনার দল নিয়ে নিয়েছে সাহায্যকারীর ভূমিকা, আর গণ্ডারেরা হয়ে উঠেছে বদমেজাজি। অন্যদিকে, মনুষ্যজাতি এতো দ্রুত খাদ্য-শৃঙ্খলের চূড়ায় উঠে পড়েছে যে, পারিপার্শ্বিক বাস্তুতন্ত্র ঠিকমতো অভিযোজিত হবার সময় পায় নি। উপরন্তু, মানুষও ঠিকমতো নিজেকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে নি। পৃথিবীর বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় শিকারি প্রজাতি যেন একেকটি রাজকীয় প্রাণী। লক্ষ লক্ষ বছরের আধিপত্য তাদের মাঝে এনে দিয়েছে অসম্ভব আত্মবিশ্বাস। সেদিক দিয়ে তুলনা করলে, হোমো সেপিয়েন্স যেন কোনো বেনানা রিপাবলিকের স্বৈরশাসক। কিছুকাল আগেও আমরা ছিলাম সাভানার অসহায় একটি প্রাণী; সেখান থেকে হঠাৎ আজকের অবস্থানে উঠে এসে আমরা যেন নিজেদের অবস্থান নিয়ে ভীত ও চিন্তিত, যা আমাদেরকে করে তুলেছে দ্বিগুণ হিংস্র ও ভয়ংকর। ইতিহাসের অসংখ্য ধ্বংসলীলা, রক্তাক্ত যুদ্ধ থেকে শুরু করে পরিবেশ বিপর্যয়ের পেছনে এই হড়বড়ে উল্লম্ফনের দায় আছে।

রাঁধুনে প্রজাতি

শীর্ষে উঠার পথে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধাপ ছিল আগুনের নিয়ন্ত্রণ। অল্প কিছু মানব প্রজাতি ৮ লক্ষ বছর পূর্বে মাঝে মধ্যে আগুন ব্যবহার করতো। তবে ৩ লক্ষ বছর আগে থেকে, হোমো ইরেক্টাস, নিয়ান্ডারথাল এবং হোমো সেপিয়েন্সের পূর্বপুরুষেরা নিয়মিতভাবে আগুন ব্যবহার করা শুরু করে। ফলে মানুষ পেল আলো ও উষ্ণতার একটি নির্ভরযোগ্য উৎস, এবং শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো সিংহ থেকে বাঁচার জন্য পেল মারাত্মক একটি অস্ত্র। নাতি-দীর্ঘকাল পরেই, মানুষেরা ইচ্ছে করেই প্রতিবেশের বন-জঙ্গল জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করে। খুব সতর্কভাবে পরিচালিত অগ্নিকাণ্ড দিয়ে একটি অনুর্বর জঙ্গলকে তৃণভূমিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব ছিল যেটি থাকবে শিকারে পরিপূর্ণ। তদুপরি, আগুন নিভে আসলে, উদ্যোগী মানুষেরা পোড়া বনভূমি ঘুরে দগ্ধ পশুপাখি, বাদাম আর কন্দ-মূল তুলে আনতে পারত।কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার ফলে সবচেয়ে অসাধারন যে বিষয়টি ঘটেছিল সেটি হলো- রান্নার উদ্ভাবন।
যেসব খাদ্য তাদের প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ খেতে পারত না- যেমন: গম, চাল, আলু- সেগুলো একেবারে প্রধান খাদ্য পরিণত হলো, রান্নার বদৌলতে। আগুন শুধু খাদ্যের রসায়নই পরিবর্তিত করে নি, এটি খাদ্যের জীববিজ্ঞানেও পরিবর্তন এনেছিল। রান্নার ফলে সেইসব জীবাণু ও পরজীবী ধ্বংস হলো যা খাদ্যে উপদ্রব সৃষ্টি করতো। ফলমূল, বাদাম, পোকামাকড় আর মাংস সেদ্ধ করে খেতে শুরু করায় মানুষকে খাবার চিবানো ও হজম করার পেছনে আগের তুলনায় অনেক কম সময় ব্যয় করলেই চলতো। যেখানে শিম্পাঞ্জীরা দিনে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা শুধু কাঁচা খাদ্য চিবোয়, সেখানে রন্ধিত খাবার গ্রহণ করায় মানুষের শুধু এক ঘণ্টা খরচ করলেই চলে।
রান্নাবান্নার আবির্ভাব মানুষকে অল্প সময়ে বিভিন্ন প্রকার খাবার খাওয়ার সুযোগ করে দিল, এবং দাঁত ও অন্ত্র-নালীর সংক্ষেপণে সাহায্য করল। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে, রান্নার আবির্ভাবের সাথে মানুষের অন্ত্রনালী ছোট হয়ে আসা এবং মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক আছে। যেহেতু বিশাল মস্তিষ্ক ও দীর্ঘ অন্ত্রনালী দু’টোই প্রচুর শক্তি ব্যয় করে, তাই একসঙ্গে দু’টোরই দেখভাল করা কঠিন। অন্ত্রনালী ছোট হয়ে আসায় ও শক্তিব্যয় কমিয়ে দেয়ায়, রান্নাবান্নার আবির্ভাব মূলত কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই নিয়ান্ডারথাল ও সেপিয়েন্সের বিশাল মস্তিষ্ক অর্জনের পথ সুগম করে দিয়েছিল।
মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের মাঝে সর্বপ্রথম তাৎপর্যপূর্ণ বিভাজন-রেখা তৈরি করেছিল আগুন। প্রায় সব পশুপাখির ক্ষমতা বা শক্তি তাদের শরীরের ওপর নির্ভর করে, যেমন: তাদের পেশীর শক্তি, দাঁতের আকার, পাখার বিস্তার। যদিও কেউ কেউ বাতাস ও স্রোতকে কাজে লাগাতে জানে, কিন্তু কেউই এসব প্রাকৃতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এবং সর্বদাই তাদের শারীরিক সামর্থ্যের প্রাচীরে আবদ্ধ থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ঈগল ভূমি থেকে উর্ধমুখী বায়ু-স্তম্ভ সনাক্ত করতে পারে, এরপর বিশাল পাখা ছড়িয়ে দিয়ে উষ্ণ বায়ুর সাহায্যে আরো উপরে উঠে যায়। কিন্তু ঈগল কোনোভাবেই এই বায়ু-স্তম্ভের অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এবং তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য সুস্পষ্টভাবে নির্ভর করে তাদের পাখার ব্যাপ্তির ওপর।
যখন মানুষ আগুন বশে আনল, তারা মূলত একটি অনুগত ও অসীম ক্ষমতাধর শক্তি লাভ করল। ঈগল না পারলেও, মানুষ লভ্য এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। মানুষ ইচ্ছেমত যখন খুশি এবং যেখানে খুশি আগুন জ্বালাতে পারতো, এবং আগুনকে দিয়ে যেকোনো ধরনের কাজ করিয়ে নিতে পারতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো, আগুনের ক্ষমতা কিন্তু মানুষের আকার, আকৃতি কিংবা শক্তির ওপর নির্ভর করে না। একজন নারী সামান্য কিছু পাথর কিংবা জ্বলন্ত কাঠ ব্যবহার করে একাই পুরো একটি বন জ্বালিয়ে দিতে পারত, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। আগুনের এই বশীকরণ ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে অনাগত যুগে অনেক কিছুই ঘটতে চলেছে।

সহোদরের রক্ষক

আগুনের সুবিধাবলী পাওয়া সত্ত্বেও, ১৫০,০০০ বছর আগেও মানুষেরা ছিল প্রান্তীয় প্রজাতিগুলোর একটি। ওরা ভয় দেখিয়ে সিংহের পাল তাড়াতে পারতো, শীতের রাতে নিজেদের উষ্ণ রাখতে পারতো, এবং মাঝে মধ্যেই বন-জঙ্গল পুড়িয়ে দিত। তারপরও সবগুলো প্রজাতি মিলে, সেই ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ পর্যন্ত সম্ভবত ১ মিলিয়নের বেশি মানুষ এই ধরণীতে বাস করতো না, যা বাস্তুতন্ত্রের রাডারে সামান্য কণিকার বেশি কিছু নয়।
ততোদিনে আমাদের প্রজাতি মানে ‘হোমো সেপিয়েন্স’ পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু ওরা কেবলই আফ্রিকার একটি কোণে বসবাস করে নিজেদের চরকায় তেল দিচ্ছিল। আমরা একেবারে নির্ভুলভাবে বলতে পারি না, ঠিক কবে আর কখন সেইসব প্রাণী, যাদেরকে ‘হোমো সেপিয়েন্স’ নামে নির্দেশ করা যায়, পূর্ববর্তী মানব প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়েছে; তবে সব বিজ্ঞানীই একমত যে, ১৫০,০০০ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকা সেপিয়েন্স-এ পরিপূর্ণ ছিল- যারা দেখতে ঠিক আমাদের মতোই। যদি তাদের কাউকে আজকের দিনের আধুনিক মর্গে পাওয়া যায়, সাধারণ চিকিৎসকেরা তেমন অদ্ভুত কিছুই লক্ষ করবেন না। আগুনের বদৌলতে, ততোদিনে তাদের দাঁত ও চোয়াল পূর্বসুরিদের তুলনায় ছোট হয়ে এসেছে, এবং মস্তিষ্কের আকার বেড়ে হয়েছে আমাদের সমান।
বিজ্ঞানীরা আরো একমত যে, প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, কিছু সেপিয়েন্স পূর্ব আফ্রিকা ছেড়ে আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে, এবং সেখান থেকে তারা খুব দ্রুত পুরো ইউরেশিয়ান ভূখণ্ডে বিস্তার লাভ করে।



যখন হোমো সেপিয়েন্স আরবে উপস্থিত হয়, সেসময় ইউরেশিয়ার প্রায় সব অঞ্চলে অন্যান্য মানব প্রজাতির আবাস ছিল। তাদের কী হলো? এক্ষেত্রে দু’টো পরস্পরবিরোধী মতবাদ আছে। এদের একটি- ‘আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন মতবাদ’ বলছে আকর্ষণ, প্রজনন ও মিলনের গল্প। এ মতবাদ অনুসারে- আফ্রিকান অধিবাসীরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে, অন্যান্য প্রজাতির মানব-সদস্যদের সঙ্গে প্রজননে লিপ্ত হয়, এবং আজকের পৃথিবীর মানুষেরা হলো এই আন্তঃপ্রজাতি জননের ফলাফল।
যেমন ধরুন, সেপিয়েন্স যখন মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পৌঁছে, তখন তারা নিয়ান্ডারথালদের মুখোমুখি হয়। এই প্রজাতির মানবেরা সেপিয়েন্সের তুলনায় ছিল পেশীবহুল, তাদের মস্তিষ্ক ছিল বড়ো, এবং ঠাণ্ডা জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। তারা পাথুরে হাতিয়ার ও আগুন ব্যবহার করতো, ছিল খুব ভালো শিকারি, এবং খুব সম্ভবত অসুস্থ ও রুগ্ন মানুষদের খেয়ালও রাখতো। (প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এমন সব নিয়ান্ডারথালদের দেহাবশেষ আবিষ্কার করেছেন যারা বহুকাল শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেঁচে ছিল, যা প্রমাণ করে যে- নিয়ান্ডারথালরা তাদের স্বজনের দেখভাল করত।) নানা ব্যঙ্গচিত্রে নিয়ান্ডারথালদেরকে প্রায়ই চিত্রিত করা হয় পশুতুল্য ও নির্বোধ গুহামানব হিশেবে; কিন্তু সাম্প্রতিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এই চিত্র পাল্টে দিয়েছে।
আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন মতবাদ অনুসারে, যখন সেপিয়েন্সরা নিয়ান্ডারথালদের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডারথাল মিলিত হয়ে একটি প্রজাতিতে পরিণত হয়। এটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ইউরোপ-এশিয়ার অধিবাসীরা খাঁটি সেপিয়েন্স নয়; তারা সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডারথালের সংমিশ্রণ। একইভাবে, সেপিয়েন্সরা যখন পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছুল তখন তারা মিলিত হলো স্থানীয় ইরেক্টাসদের সঙ্গে; সুতরাং চীনা আর কোরিয়ানরা হলো সেপিয়েন্স আর ইরেক্টাসের মিশাল।
তবে বিপরীত তত্ত্ব, “প্রতিস্থাপন মতবাদ”, কিন্তু খুবই ভিন্ন একটি গল্পই শোনাচ্ছে- যে গল্প অসম্পৃক্ততার, বিরূপ প্রতিক্রিয়ার এবং সম্ভবত গণহত্যার। এই মতবাদ অনুসারে, সেপিয়েন্স এবং অন্যান্য মানব প্রজাতির দৈহিক গঠনতন্ত্র ছিল ভিন্ন ধরনের, এবং খুব সম্ভবত তাদের প্রজনন প্রবণতা এবং এমনকি গায়ের গন্ধও ছিল বিসদৃশ। একে অপরের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা তাদের খুব একটা থাকার কথা নয়। এবং এমনকি যদি কোনো নিয়ান্ডারথাল রোমিও আর সেপিয়েন্স জুলিয়েট প্রেমে পড়ে যেত, তারা উর্বর সন্তানসন্ততি জন্ম দিতে পারত না, কারণ দু’টো জনগোষ্ঠীর মাঝে ইতোমধ্যেই যে জিনগত প্রাচীর বা বাধা গড়ে ওঠে তা ছিল দুরতিক্রম্য। দু’টো জনগোষ্ঠীই ছিল পরস্পর হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, এবং যখন নিয়ান্ডারথালরা একে একে মারা পড়ে বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়, তখন তাদের সাথে সাথে তাদের জিনও হারিয়ে যায়। এই মতবাদ অনুসারে, সেপিয়েন্সরা পূর্ববর্তী সকল প্রজাতির জনগোষ্ঠীকে প্রতিস্থাপিত করেছে তাদের সাথে মিলিত না হয়েই। যদি এটি সত্যি হয়, তাহলে আধুনিক মানুষদের বংশলতিকা ধরে পেছনের দিকে গেলে সবার পূর্বপুরুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে ৭০,০০০ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকায়। আমরা সবাই হবো ‘খাঁটি সেপিয়েন্স’।
এই বিতর্কের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। বিবর্তনীয় প্রেক্ষাপট থেকে তাকালে, ৭০ হাজার বছর অপেক্ষাকৃত ছোট সময়কাল। ‘প্রতিস্থাপন মতবাদ’ নির্ভুল হলে, সব জীবিত মানুষই মোটামুটি অনুরূপ জেনেটিক লটবহর বহন করছে, এবং তাদের মধ্যকার জাতিগত প্রভেদকে উপেক্ষা করা চলে। কিন্তু যদি ‘আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন মতবাদ’ সঠিক হয়, তাহলে আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান ও এশিয়ানদের ডিএনএতে আছে জিনগত ভিন্নতা। এটি একটি রাজনৈতিক বোমা, যা বর্ণবাদী আদর্শগুলোর বিস্ফোরণে ইন্ধন জোগাতে পারে।
বিগত দশকগুলোয় প্রতিস্থাপন মতবাদ সাধারণ সত্য হিশেবে গণ্য করা হতো। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো এই মতবাদকে সমর্থন করেছে, এবং এটি ছিল অধিক ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ ( বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভেতরে জেনেটিক ভিন্নতা থাকার কথা দাবি করে বিজ্ঞানীরা বর্ণবাদের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিতে চান নি)। কিন্তু এই চিত্র পাল্টে যায় ২০১০ সালে, যখন নিয়ান্ডারথাল জিনোমের মানচিত্র তৈরির চার বছরব্যাপী একটি প্রচেষ্টার ফলাফল প্রকাশিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ফসিল থেকে যথেষ্ট পরিমাণ নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ উদ্ধার করতে পেরেছেন যা দিয়ে তারা নিয়ান্ডারথাল ও আধুনিক মানুষের ডিএনএ’র বিস্তৃত তুলনা করেছেন। এর ফলাফল পুরো বিজ্ঞানী সমাজকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
দেখা গেল যে, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে বসবাসকারী আধুনিক জনগোষ্ঠীর ডিএনএ’তে থাকা অনন্য মনুষ্য-ডিএনএ’র প্রায় ১-৪ শতাংশ মূলত নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ। এই পরিমাণটি হয়ত খুব বেশি নয়, কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েক মাস পর এলো দ্বিতীয় ধাক্কা, যখন প্রস্তরীভূত আঙুল থেকে পাওয়া ডিএনএ’এর সাহায্যে ডেনিসোভা মানবদের জিনোম-মানচিত্র তৈরি হলো। ফলাফলে থেকে দেখা গেল, আধুনিক মেলানেশিয়ান ও আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের অনন্য মনুষ্য-ডিএনএ’র সাথে ডেনিসোভান ডিএনএ’র প্রায় ৬ শতাংশ পর্যন্ত মিল আছে।
যদি এই ফলাফলগুলো নির্ভুল হয়ে থাকে- (এবং মনে রাখা ভালো যে এই বিষয়ে আরো গবেষণা এই মুহূর্তে চলছে এবং সেগুলোর ফলাফল উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলোকে পরিবর্তন কিংবা আরো শক্তিশালী করতে পারে)- তাহলে আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন মতবাদে কিছুটা হলেও সত্যতা আছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, প্রতিস্থাপন মতবাদ পুরোপুরি ভুল। যেহেতু নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানরা আমাদের আধুনিক-কালের ডিএনএ’তে খুবই সামান্য অবদান রেখেছে, সেহেতু সেপিয়েন্স ও অন্যান্য মানব প্রজাতির মধ্যে পরিপূর্ণ সম্মেলন ঘটেছে- এমনটা বলা দুরূহ। যদিও তাদের ভেতরকার যে পার্থক্যগুলো ছিল তা যথেষ্ট বড়ো ছিল না- যেন তাদের মধ্যকার যৌনমিলন সম্পূর্ণ রোধ করা যায়, তবে তা পর্যাপ্ত ছিল যেন ওই মিলনগুলোকে খুবই বিরল ঘটনায় পরিণত করা যায়।
তাহলে আমরা কীভাবে সেপিয়েন্স, নিয়ান্ডারথাল আর ডেনিসোভানদের জৈবিক সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করব? স্পষ্টতই, তারা ঘোড়া ও গাধার মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো প্রজাতি নয়। আবার অন্যদিকে, ওরা বুলডগ আর স্প্যানিয়েলের মতো একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্য নয়। জীববিজ্ঞানের বাস্তবতা শুধু সাদা আর কালোয় তৈরি নয়, এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধূসর এলাকাও রয়েছে। ঘোড়া ও গাধার মতো দু’টি প্রজাতি, যারা একটি সাধারণ পূর্বসুরি থেকে বিবর্তিত হয়েছে, তারা অতীতের কোনো একসময় একই প্রজাতির ভিন্ন দু’টি জনগোষ্ঠী হিশেবে টিকে ছিল, অনেকটা বুলডগ আর স্প্যানিয়েলের মতোই। তাদের বিবর্তনীয় রেখায় নিশ্চয়ই এমন কোনো বিন্দু ছিল, যেখানে ইতোমধ্যেই তারা পরস্পর থেকে যথেষ্ট ভিন্নতা অর্জন করেছে কিন্তু খুবই বিরল উপলক্ষে তারা যৌনমিলন ও উর্বর সন্তান জন্মদানে সক্ষম ছিল। এরপর হয়ত অন্য কোনো মিউটেশন তাদের মধ্যকার সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে দেয়, এবং তারা বিবর্তনের পথ ধরে পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়।
মনে করা হয়, ৫০ হাজার বছর আগে, সেপিয়েন্স, নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভানরা সেই সীমারেখায় দাঁড়িয়ে ছিল। তারা ছিল প্রায় সম্পূর্ণ পৃথক প্রজাতি, তবে পুরোপুরি নয়। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব যে, সেপিয়েন্সরা ইতোমধ্যেই নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানদের চেয়ে কেবলমাত্র জিনগত ও দৈহিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেই নয়, বরং চৈতন্য ও সামাজিক দক্ষতার দিক থেকেও স্বতন্ত্রতা অর্জন করেছিল; এরপরও এমনটাই প্রতীয়মান হয় যে খুবই বিরল উপলক্ষে একটি সেপিয়েন্স ও একটি নিয়ান্ডারথালের মিলনে উর্বর সন্তান জন্ম নেয়া সম্ভব ছিল। সুতরাং দু’টো জনগোষ্ঠী একীভূত হয় নি, তবে অল্প কিছু সৌভাগ্যবান নিয়ান্ডারথাল জিন ‘সেপিয়েন্স এক্সপ্রেসে’ চড়ে বসতে পেরেছিল। এটা ভাবাই খুব রোমাঞ্চকর যে, আমরা, সেপিয়েন্সরা অতীতের কোনো একসময় অন্য এক প্রজাতির প্রাণীর সাথে যৌনমিলন এবং সন্তানসন্ততি জন্মদানে সক্ষম ছিলাম।
কিন্তু যদি নিয়ান্ডারথাল, ডেনিসোভান এবং অন্যান্য প্রজাতির মানুষেরা সেপিয়েন্সের সাথে একীভূত না হয়, তাহলে এরা সবাই বিলুপ্ত হয়ে গেল কেন? একটি সম্ভাবনা হলো- হোমো সেপিয়েন্স তাদেরকে বিলুপ্তির পথে চালিত করেছে। কল্পনা করুন, একটি সেপিয়েন্সের একটি দল বলকান উপত্যকায় পৌঁছুল যেখানে নিয়ান্ডারথালরা হাজার বছর ধরে বাস করে আসছে। আগন্তুক মানবেরা হরিণ শিকার করতে শুরু করল এবং বাদাম ও ফলমূল সংগ্রহ করা আরম্ভ করল- যা এতদিন ছিল নিয়ান্ডারথালদের খাদ্যের প্রধান উৎস। নতুন প্রযুক্তি এবং উচ্চতর সামাজিক নৈপুণ্যের কারণে সেপিয়েন্সরা ছিল অধিক দক্ষ শিকারি ও সংগ্রাহক, ফলে ওরা সংখ্যাবৃদ্ধি করতে লাগল এবং আরো ছড়িয়ে পড়ল। এতে অপেক্ষাকৃত কম করিৎকর্মা নিয়ান্ডারথালদের পক্ষে নিজেদের জন্য যথেষ্ট খাদ্য জোগানো ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়ল। ক্রমশ তাদের সংখ্যা হ্রাস পেল এবং ধীরে ধীরে তাদের সবাই মারা পড়ল, সম্ভবত দু’য়েক জন ছাড়া- যারা প্রতিবেশী সেপিয়েন্সের দলে যোগদান করে বেঁচে যায়।
আরেকটি সম্ভাবনা হলো- সম্পদের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা- সহিংসতা ও গণহত্যায় ইন্ধন যুগিয়েছিল। সহনশীলতা সেপিয়েন্সের স্বাভাবিক কিংবা স্বতন্ত্র কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। আজকের আধুনিক যুগেও, এক দল সেপিয়েন্সকে উত্তেজিত করে তুলে অপর এক দলকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার প্রণোদনা যোগাতে কেবলমাত্র গায়ের বর্ণ, ভাষা কিংবা ধর্মের সামান্য পার্থক্যই যথেষ্ট। তাহলে প্রাচীন সেপিয়েন্সরা কি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানব প্রজাতির প্রতি সহনশীল ছিল? এটা হতে পারে যে, সেপিয়েন্সরা যখন নিয়ান্ডারথালদের মুখোমুখি হয় তখন পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ জাতিগত গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।
যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, নিয়ান্ডারথালদের ( এবং অন্যান্য মানব প্রজাতি) বিলুপ্তি মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ‘কেমন হতো যদি’-প্রশ্নগুলো করছে। ভেবে দেখুন, কেমন হতো যদি হোমো সেপিয়েন্সের পাশাপাশি নিয়ান্ডারথাল কিংবা ডেনিসোভানরা শেষ পর্যন্ত বেঁচে যেত। কী ধরনের সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং রাজনৈতিক কাঠামোর আবির্ভাব পৃথিবীতে ঘটতো যদি বিভিন্ন ধরনের মানব প্রজাতি একই সঙ্গে বসবাস করতো? উদাহরণস্বরূপ, কেমন করে ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো বিকশিত হতো? বাইবেলের আদি-পুস্তকে কি ঘোষণা করা হতো যে নিয়ান্ডারথালরা আদম ও ইভের উত্তরসুরি, যিশু কি ডেনিসোভানদের পাপের জন্যও নিজেকে উৎসর্গ করতেন, এবং কোরানে কি সব ধার্মিক মানুষদের জন্য স্বর্গের সিট বরাদ্দ করা হতো-সে যে প্রজাতিরই হোক না কেন? নিয়ান্ডারথালরা কি রোমান সেনাবাহিনী কিংবা চীনা সাম্রাজ্যের সুবিস্তৃত আমলাতন্ত্রে চাকুরী করার সুযোগ পেত? আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে কি এটা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়া হতো যে ‘হোমো’ গণের সকল সদস্যকে সমকক্ষ হিশেবে সৃষ্টি করা হয়েছে? কার্ল মার্ক্স কি সব প্রজাতির শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক দিতেন?
বিগত ১০ হাজার বছর ধরে, হোমো সেপিয়েন্স পৃথিবীর একমাত্র মনুষ্য প্রজাতি হিশেবে নিজদেরকে দেখে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে অন্য কোনো ধরনের সম্ভাবনার চিত্র কল্পনা করাই তাদের পক্ষে বেশ কঠিন কাজ। আমাদের সহোদরের অনুপস্থিতি আমাদের জন্য এটা ভাবা সহজতর করে তুলেছে যে আমরাই হলাম সৃষ্টি-জগতের প্রতীক, এবং বাকি প্রাণীজগতের সাথে আমাদের রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। চার্লস ডারউইন যখন ইঙ্গিত দিলেন যে হোমো সেপিয়েন্স কেবলই অন্য এক ধরনের প্রাণী মাত্র, লোকজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমনকি আজও অনেকেই এই সত্যটি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। যদি কোনোভাবে নিয়ান্ডারথালরা টিকে থাকত, তখনও কি আমরা নিজেদেরকে এই জগৎ হতে বিচ্ছিন্ন কোনো সৃষ্টি হিসেবে কল্পনা করতাম? হয়ত ঠিক এই কারণেই আমাদের পূর্বসুরিরা নিশ্চিহ্ন করেছিল নিয়ান্ডারথালদেরকে। তাদের সাথে এতোটা নৈকট্য ছিল যে উপেক্ষা করা যেত না, কিন্তু এতোটাই বৈপরীত্য ছিল যে মেনে নেওয়াও অসম্ভব।
সেপিয়েন্স দোষী হোক বা না-ই হোক, এটা ঠিক যে- যখনই তারা নতুন নতুন অঞ্চলে উপস্থিত হয়েছে তখনই সে অঞ্চলের আদি মানবগোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়েছে গেছে। হোমো সোলোয়েন্সিস’এর সর্বশেষ অস্তিত্বের যে প্রমাণ পাওয়া যায় তা ৫০ হাজার বছর আগের। হোমো ডেনিসোভা এর কিছুকাল পরেই বিলুপ্ত হয়। নিয়ান্ডারথালরা মোটামুটি ৩০ হাজার বছর পূর্বে প্রস্থান করে। ফ্লোরেস দ্বীপ থেকে সর্বশেষ বামন-সদৃশ মানবেরা উধাও হয় প্রায় ১২ হাজার বছর আগে। বিলুপ্ত মানব-প্রজাতিগুলো ফেলে গেছে কিছু হাড়গোড়, কিছু পাথরের হাতিয়ার, আমাদের ডিএনএ’তে অল্প কিছু জিন এবং রেখে গেছে অসংখ্য প্রশ্ন যার জবাব এখনো মেলে নি। ওরা এই পৃথিবীতে রেখে গেছে সর্বশেষ মানব প্রজাতি- হোমো সেপিয়েন্স।
সেপিয়েন্সের এমন সাফল্যের রহস্য কী ছিল? কীভাবে এতো দূরবর্তী ও ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে আমরা এতো দ্রুত আবাস গড়ে তুলেছিলাম? কেমন করে আমরা অন্য সব মানব প্রজাতিকে বিস্মৃতির দিকে ঠেলে দিয়েছিলাম? কেন শক্তিশালী, বুদ্ধিমান, শৈত্য-জয়ী নিয়ান্ডারথালরা আমাদের আক্রমণ ঠেকিয়ে টিকে পারে নি? এসব নিয়ে বিতর্ক চলছেই। এর সম্ভাব্য উত্তর হলো ঠিক সেই জিনিশটিই যা আমাদের এই বিতর্ককে সম্ভব করে তুলেছে- হোমো সেপিয়েন্স পুরো পৃথিবী জয় করেছে তাদের অনন্যসাধারণ ভাষার বদৌলতে।

0 comments: